“ ধূসর ধ্বংস স্তুপের সবুজ ঘাসফড়িঙ ”

 “ ধূসর ধ্বংস  স্তুপের সবুজ ঘাসফড়িঙ ”


“ ধূসর ধ্বংস  স্তুপের সবুজ ঘাসফড়িঙ ”



আমার ভার্সিটির বন্ধুরা আমাকে ঘরকুনো  বললে আমার খারাপ লাগে না।আমার মেসের ছোট রুমটাই আমার প্রিয়।পয়সাওলায়া বন্ধুরা যখন বিভিন্ন রেস্টূরেন্ট গিয়ে হ্যাং আউট করে বেড়াই আমি মেসের ডিম ভাজি আর ভাত খাই।বিশেষ দিনে যখন তারা পার্কে গিয়ে ঘুরে বেড়াই আমি তখন অজুহাত দিই।এগুলো আমার অভ্যাস হয়েছে অনেক আগেই।নিজের অর্থ কষ্ট অন্যের কাছে ফুটিয়ে তুলে লাভ হয় না।তাই সব কিছু একটা বড় হাসি দিয়ে লুকিয়ে ফেলি।ডিপার্টমেন্ট এর পিকনিক কিংবা টুর এসে গেলে আমার চিন্তা বাড়ে।ক্লাস ভর্তি ছেলেমেয়ে দের মধ্যে দাঁড়িয়ে  আমার কাপা গলায় অজুহাত গুলো বলতে হয় মাঝে মাঝে।  ফুলহাতা জামা পরা আমার দিকে তাকিয়ে সবাই নিতান্ত ভদ্র ছেলে মনে করবে আমি জানি।আমার জন্মদিন এসে গেলে আমি বন্ধুদের এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি ।লুকিয়ে রাখি আমার বার্থডেইট ।বলে রাখা ভালো, আমার ভার্সিটির বন্ধুরাই প্রথম কেক কেটে জন্মদিন পালন করার সুযোগ করে দেয় আমাকে।মাস শেষ হলেই মানিব্যাগ এর দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া নোট গুলোর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি।এসব নিয়ে তেমন দুক্ষ কস্ট  নেই আমার।মানিয়ে নিয়েছি সব।আজ থেকে বছর পাচেক আগে ফিরে যাবো।আমি ২০১৫ সালের শুরুতে মেসে উঠি।ছোট থেকে মেধাবী ছিলাম, সবাই বলে।গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা।২০১৫ সালের এসএসসি পরিক্ষায় জিপিএ ৫ পাই।বোর্ড বৃত্তিও পেয়ে গেলাম।বাবা মা চাইতেন ডাক্তার হই।ছেলে মেয়ে মেধাবী হলে গ্রামের মানুষদের এই একটাই ইচ্ছা দেখি প্রায়।তবে এটা আমার ইচ্ছার সাথে মিলে যায়।আমার মনে হত ডাক্তারি পেশায় অসহায় মানুষদের কস্ট সরাসরি লাঘোব করা যায়।তাইতো তখন শহরের একটা কলেজে ভর্তি হই।২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে শুরু হয় আমার মেস লাইফ।আমার বাবা পেশায় দর্জি।আমার উপর তার স্বপ্ন অনেক।মাসের শেষে বাড়িতে গিয়ে মেসের খরচ নিয়ে আসতাম।আমার উপর তার বিশ্বাস আছে।কত কিছু হিসাব করে মাস চলতে হতো আমি জানি ।১০ টাকা বাচানোর জন্য ,হেটে হেটে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছি।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই ব্রাশ নিয়ে উকিঝুকি মারছি মেসের বাথরুমে।কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে সিরিয়াল পেয়ে যাই।এরপর চোখেমুখে জল ছিটিয়ে রান্নাঘর এর  দিকে গেলাম।খাবার নিয়ে রুমে এসেই দেখলাম ৭ঃ৫০ বেজে গেছে।ব্যাগ হাতে নিয়েই দিলাম এক দৌড় ।তারপর কেমেস্ট্রি স্যারের ব্যাচ ,কলেজের ক্লাস ।এভাবেই তখন দিনের শুরু হতো।

আমার স্মার্টফোন ছিলনা তখন।মেসে গিয়ে আলাদা চেয়ার টেবিল পাই আমি পড়ার জন্য।উল্লেখ করা ভালো  বাড়িতে থাকতে আমি আমার বিছানাতে বসেই পড়তাম। শহুরে বন্ধুদের সাথে মেলামেশা খুব কম হয়েছে আমার।কিন্তু একাটা জিনিস আমাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দিতো,  তা হচ্ছে আমার বাবার মলিন মুখটা। আমি চোখ বন্ধ করলেই মাঝে মাঝে দেখতাম, গ্রামের সরু রাস্তা দিয়ে সাদা এপ্রোন পরে হেটে যাচ্ছি।অসহায় মানুষদের মাথায় হাত দিয়ে বেচে থাকার আশা জাগাবো, এটাই আমার বুকে আগলে রাখা স্বপ্ন।এভাবে দিন কেটে যাচ্ছিলো। হঠাৎ করেই আধার নেমে আসে একদিন।আমার বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়।আমারা দুই ভাই। দাদা টিউশনি করিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যেত।এই মুহুর্তে বাবা অসুস্থ হয়।পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস বন্ধ হয় হঠাৎ করেই।আমার চোখে আধার নেমে আসে। বাবার কোমরে ভীষণ যন্ত্রণা হতো।ডাক্তার দেখানোর পরও বিছানা থেকে উঠতে পারতো না।একদিন আমি বাড়িতে আসি।আমাকে দেখেই তিনি কেদে উঠেন।বাবা বলতো, "হৃদয় আমি বিছানা থেকে উঠতে পারি না।তোকে আমি ডাক্তারি পড়াবো যে। কি হয়েছে আমার"। একথা বলেই আবার কেদে উঠতো।আমার গলা ভারী হয়ে যেত কথা বলার সময়। তবুও চোখ মুছে শান্তনা দিতাম সবাইকে। খারাপ সময়ে আত্মীয় সজন দের আসল রুপ দেখা যায়।যারা দুই নৌকায় পা দিয়ে চলে, আমার নৌকা ডুবে যেতে দেখলেই অন্য দিকে চলে যায়।অনেকে সময় বুঝে  মুখ ফিরিয়ে নেয়।এটাই হয়তো দুনিয়ার নিয়ম।আমার আশেপাশে সব কিছু ধূসর ধ্বংস স্তুপ মনে হয় তখন।সেখানে এক সবুজ ঘাসফড়িঙ এর মত দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি।উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। আমি হাল ছাড়িনি পড়াশোনা চালিয়ে যাই।কিন্তু এখানেই শেষ হয়না। আরো দুর্দিন আসে। সব বন্ধুরা কোচিং করতে যাবে। অনেকে বলে, কোচিং না করলে নাকি মেডিকেলে চান্স হয় না।জীবন কত কঠিন তা উপলব্ধি করি। গ্রামের সহজ সরল ছেলে এতকিছু বুঝতাম না।শুনলাম প্রায় ১৭ হাজার টাকা দরকার। বাবাকে টাকার কথা বলার সাহস হতোনা আমার।কিন্তু আশ্চর্য বিষয় তিনি কোচিং এর ব্যাপারে জেনে গেলেন।সৃষ্টিকর্তার কি খেলা! তখন বাবা একটু সুস্থ্য হলো। আবার কাজ করা শুরু করেছিল।একদিন আমাকে নিয়ে খুলনা গেলো বাবা।১৪ হাজার টাকা দিয়ে কোচিং এ ভর্তি হলাম।একটা টিনের ছাউনি দেয়া মেসে উঠলাম সেখানে।ভয় আরো বেড়ে গেলো। এতটাকা বাবা তখন কিভাবে ম্যানেজ করলো তা জানতে চাওয়ার সাহস আমার হয়নি। কিন্তু সে কারো সাহায্য চাইবে না, এটা আমি নিশ্চিত। এইচ এস সি রেজাল্টে জিপিএ ৫ মিস করলাম। আমি বাবাকে বুঝালাম, আমি চেষ্টা করবো শেষ পর্যন্ত। সকালে প্রায়ই না খেয়ে থাকতাম। দুপুরে হোটেলে ডিম ভাত খেয়েছি বহুদিন। এসব তখন আমার কাছে খুব সহজকাজ। শহুরে রাস্তায়  অসহায় গরীব দের সাথে প্রায়ই দেখা হয় আমার। হোটেল থেকে বের হওয়ার সময়, বৃদ্ধা মহিলা আমার কাছে হাত পেতে বলতো "বাবা পাঁচটা টাকা দে, ভাত খাবো। "আমি পকেটে থেকে কিছু টাকা বের করে দিতাম।কাউকে একটু হাসাতে পারলেই আমার আনন্দ। এভাবেই নতুন শহরে মেডিকেল পরিক্ষার প্রস্তুতি নিলাম।কয়েকমাস পরে পরিক্ষা দিলাম। উচ্চমাধ্যমিক রেজাল্টে একটু কম থাকার জন্য চান্স হলো না সরকারী মেডিকেল কলেজে। আমার বহুদিনের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ওখানেই শেষ হলো।সেদিনের কথা বলে বুঝানো যাবে নাহ কতটা খারাপ সময় গেছে।  আরেকবার ধূসর ধ্বংস স্তুপ মনে হলো আমার পায়ের তলার মাটি।আত্মীয় আর গ্রামের মানুষ বিভিন্ন কথা বলা শুরু করলো। কারন আমার ছোট গ্রাম থেকে কেউ এত টাকা খরচ করে ছেলেকে শহরে কোচিং করায় না।হ্যা তবে আমি থেমে থাকিনি। আদা জল খেয়ে লেগে গেলাম।ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছি।  অনেক বাধা বিপত্তি কাটিয়ে কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিক্ষা দিলাম।তারপর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর ফার্মেসী বিভাগে পড়ার সুযোগ পেলাম।অবশেষে ধূধূ মাঠে বৃষ্টি নামে।জীবনে খারাপ সময় আসে।কিন্তু আমি মনে করি আকাশে মেঘ না করলে সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা যায়না।এখন বাবা মা ও খুশি।তাদের ছেলে তাদের হতাশ করেনি।ডাক্তার হতে পারি নাই। কিন্তু সাদা এপ্রোন গায়ে জড়ানোর স্বপ্ন আমার পুরোন হয়েছে। ধবধবে সাদা এপ্রোন গায়ে জড়িয়ে এখন ল্যাবে ঘুরে বেড়াই।মানুষের জীবন রক্ষাকারী ঔষুধ নিয়ে ঘাটাঘাটি করি। অন্য পেশাতেও যে সরাসরি মানুষের মন জয় করা যায়। এটা এখন বুঝি।গ্রামে গেলেই, আমাকে বিভিন্ন ঔষুধ নিয়ে প্রশ্ন করে মানুষ। আমিও যতটুকু জানি, ভালোভাবে বুঝাতে পারি।এই মাটিতে আমি বেড়ে উঠেছি।এখানের মানুষদের ঔষুদের সঠিক ব্যাবহার এর পরামর্শ দিতে পারলেই আমি খুশি হই।সৃষ্টিকর্তা আমাকে সুযোগ দিয়েছেন।আমার বাবা মায়ের আশীর্বাদ ছিলো। আজীবন মানুষের কল্যানে কাজ করে যেতে চাই।বাবামায়ের এই হাড়ভাঙা খাটুনির থেকে মুক্তি দিতে চাই। জানিনা সে স্বপ্ন টা পুরোন হবে কিনা। আমি অপেক্ষা করবো। সত্যকে আমি ভালোবাসি।ধ্বংসের ছাই থেকে জন্ম নেবে সত্যের ফিনিক্স। এটাই আশা।ধূসর ধ্বংস স্তুপ সবুজে ভরে উঠবে।।

লেখক :
হৃদয় কুমার পাল।
শিক্ষার্থী 
ফার্মেসী বিভাগ
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Theme images by TayaCho. Powered by Blogger.